প্রকাশিত: Sat, Apr 20, 2024 1:47 PM
আপডেট: Sun, May 19, 2024 5:38 AM

সৌজন্যতার ‘ঈদ মোবারক’ ও ‘শুভ নববর্ষ’

তোফায়েল আহমেদ : আমাদের সামাজিকতায় ‘শুভ নববর্ষ’ কিংবা ‘ঈদ মোবারক’ জাতীয় অভিবাদন খুব বেশ দিনের নয়। তাই বলে নতুন বছরকে বরণ করা বা ঈদে অভিবাদনের প্রচলন কি ছিল না? অবশ্যই ছিল। উদযাপনের  ধরন, মেজাজ, উপায়-উপকরণে ভিন্নতা ছিল। দিন দিন যান্ত্রিক সৌজন্যতার প্রাবল্যে হৃদয়ের টান ও আন্তরিকতার সম্পর্ক মার খেয়ে যাচ্ছে কিনা ভেবে দেখতে অনুরোধ করি। [১] নববর্ষ জমিদার বাড়িতে প্রজাদের আগমন ঘটত নানা উপহার- উপঢৌকন নিয়ে, গোমেস্তা খাজনায় কিছু ছাড় দিত। দৈ, খৈ, মুড়ি, মোয়া, মিস্টি পরিবেশিত হতো। গ্রামে গ্রামে মেলা বসত। বছরের অনেক প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র মাটির হাড়ি, ডালা, কুলা, রঙিন ফিতা, চুড়ি, আলতা প্রভৃতি গ্রামের মানুষ এ সব মেলা থেকে সংগ্রহ করত। 

স¤প্রদায়ভিত্তিক, পেশাভিত্তিক, সর্বজনীন নানা রকমফের নিয়ে নানাভাবে বাংলা নববর্ষ উদযাপিত হতো। সনাতনী ধর্ম স¤প্রদায় চৈত্র সংক্রান্তির অনেক আনুষ্ঠানিকতা পালন করত। তারপর নববর্ষ। পাইকারী ব্যবসায়ীর গদিতে হালখাতা উৎসব রীতিমত নতুন বছরের নতুন হিসাব নিকাশের দিন। শিশু-কিশোররা নতুন খেলনা কাঠের পুতুল, মাটির ঘোড়া, বাশের বাঁশি কত কিছুর জন্য সারা বছর অপেক্ষা করত। চট্টগ্রাম অঞ্চলে বলি খেলা, ষাঁড়ের লড়াই সাথে কয়েক দিনের মেলা ছিল বোশেখের প্রধান আকর্ষন। এখন গৃহস্ত নেই, নেই গৃহস্তের ষাঁড়, নেই খালি মাঠ। ষাড়ের লড়াই বিলুপ্ত। এখন শিশু-কিশোররা শুধু ভাল ফলাফলের নেশায় পড়ায় বুঁদ হয়ে থাকে, খেলে সময় নষ্ট করে না। তাই কুস্তি খেলা, বলি খেলার অবকাশ কোথায়?

তবে টিভিতে খেলা দেখে এবং রাত জেগে ভিডিও গেইম খেলে, ইউটিউব দেখে তারা আর অন্য কিছু করার সময় কম পায়। তাই নববর্ষ আসলে ‘শুভ নববর্ষ’ এসএমএস লিখে দায় সারে মোটামুটি ছোট বড় সবাই। তবে ঢাকা সহ নানা শহরে কিছু তরুণ মঙ্গল শোভাযাত্রা, নানা মুখোস পরে ঢোল করতাল বাজিয়ে আনন্দ করা নববর্ষ অনুষ্ঠানে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। রমনায় সকালের জমায়েত এটি একটি ঢাকার অতি জনপ্রিয় অনুষঙ্গ। এখন শুধু রমনা নয় অনেক পার্ক ও উম্মুক্ত স্থানে সকালে জমায়েত হয়। নতুন পাঞ্জাবী ও নতুন শাড়ি পরার একটি জনপ্রিয় রীতি চালু আছে। 

এক সময় পান্থা-ইলিশের খুব ধুম চলছিল। ইদানিং এটির গুরুত্ব কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। আজকাল ‘নববর্ষ’ করপোরাটাইজ হয়ে যাচ্ছে। অনেক ব্যবসা হাউজ অনেক খরচ করে। ইংরেজী নববর্ষ এবং বাংলা নববর্ষ দুটি আবার শ্রেণীভেদে ভিন্ন মেজাজে উদযাপিত হয়। ঢাকার  শিক্ষিত মধ্যবিত্ত  রমনা বটমূলে, অন্যান্য শহরেও একই শ্রেণীর নানা তরুতলে ‘এসো হে বৈশাখ’ গেয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানায়। তারকাচিহ্নিত হোটেলগুলোয় ‘দই-চিড়া’ ব্রেকফাস্ট হয়। রাতে ‘পান’ উৎসব হয়। গরীব আদিবাসীগণ তাড়ি উৎসব করে। সাধারণ সনাতন পরিবারে নিরামিশ পঞ্চব্যঞ্জন রান্না হয়। 

মিস্টি সবার সাধারণ আপ্যায়ন। বাংলা নববর্ষ সকালে শুরু হলেও ইংরেজী নববর্ষ শুরু হয় মাঝরাতে। আদর-আপ্যায়ন, হৈচৈ মাতামাতি সবই রাতে। খ্রীষ্টিয় জগত ২৫ডিসেম্বরে যীশু জম্মদিন পালনের পর পর একই আমেজে নববর্ষ পালন করে। আলোকসজ্জা-আতশবাজি, পারিবারিক মিলন, পান উৎসব, বছরের সেরা আকর্ষন। সেটি এক ধরনের সংক্রমণ খ্রীস্টীয় জগতের বাইরেও ব্যাপকভাবে হয়েছে। চিনসহ ঐ সন্নিহিত অঞ্চলে ভিন্নভাবে তাদের নববর্ষ উৎযাপান করলেও ১লা জানুয়ারীও তারা উৎসবে মাতে। এখন সরকারি চাকুরিজীবিগণ বাংলা নববর্ষ উৎসব ভাতা পান। আগে তা ছিল না। ভবিষ্যতে ইংরেজী নববর্ষ ভাতাও যুক্ত হয় কিনা জানি না। কারণ বাস্তবিক দিক থেকে বাংলা থেকে ইংরেজী সন-তারিখ আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় অনেক বেশী গুরুত্ব বহন করে। ইংরেজী বর্ষপঞ্জিই আমাদের সত্যিকারের বর্ষপঞ্জি।

[২] ঈদ প্রসঙ্গ: ঈদ উৎসব বটে, তবে তা প্রথমত ও প্রধানত ধর্মীয় উৎসব। আরবী শাওয়াল মাসের প্রথম তারিখ ঈদ পালিত হয়। দ্রæপদী ধর্মীয় ধারায় ঈদ তাদেরই উৎসব যারা শাওয়ালের আগের এক মাস উপবাস ও নানা আনুসঙ্গিক কঠোর সংযম পালন করেছে। এর সাথে নিবিষ্ট উপাসনা, দান-খয়রাত ও নতুন জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হবার ঐকান্তিকতা যুক্ত। দিনের শুরু হয় রোজার ফিতরা আদায় ও সমবেত উপাসনার মাধ্যমে, ঈদের জামাত ও খুৎবা এ দিবসের প্রাণ। এটি দেশ, কাল, পাত্র নয় সারা পৃথিবীর মুসলমানের সর্বজনীন রীতি। বাকি  জাতি,দেশ ও সমাজভেদে  নানা সামাজিক রীতিনীতির মিশ্রণ স্বাভাবিকভাবে হবে, তা দোষনীয় নয়। 

নতুন পোশাক পরা, নিজে ভাল খাওয়া ও অন্যকে খাওয়ানো অবশ্যই ঈদের অঙ্গীভ‚ত আনুষ্ঠানিকতা। কিন্তু ঐ অংশটিই ঈদের প্রধান আবশ্যকীয় ধর্মীয় বিধান নয়। তবে পালনীয়। এখন আসি দায়সারা ‘ঈদ মোবারক’ প্রসঙ্গে। ঈদে সরাসরি জামায়াত ও সাক্ষাত, কোলাকোলি, শুভেচ্ছা বিনিময়। আত্মীয়-স্বজনের খোঁজ-খবর নেয়া মুসলিম সংস্কৃতির অংশ। আজকাল নৈর্ব্যক্তিক এসএমএস, মেসেঞ্জার, টুইটার, নানা ইলেকট্রনিক ডিভাইসে ‘ঈদ মোবারক’ পাঠানের মধ্যে হৃদয়ের সংযোগ খুব একটা থাকছে তা হলপ করে বলা যায় না। একটি সাধারণ সৌজন্যতা দেখানো হয় মাত্র। এক দশক আগে পর্যন্ত নানা সুন্দর বাণী লেখা ঈদ কার্ড বিনিময় ছিল। এখন সে ঝামেলায় কে যায়? তা ব্যয়বহুল ও সময় সাপেক্ষ। এভাবে ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির আন্তরিক যোগাযোগ কমছে। যন্ত্রের কাজ যন্ত্র করছে। সব সময় যন্ত্র ও যান্ত্রিকতা মানবিক সম্পর্ক রক্ষা ও বিকাশের বিকল্প মাধ্যম নয়। এক্ষেত্রে সৌজন্যতার ‘ঈদ মোবারক’ কোনভাবেই যায় না। এটি একটি ভাবনার বিষয়। ১৩-৪-২৪। ফেসবুক থেকে